রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

মামা কাহিনীঃ বাড়ীওয়ালার ছেলে ভেবে হয়েছিল ভুল!

অনেক দিন মামার সাথে দেখা হয় না। আমরা দুইজনেই বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যস্ততা বাড়িয়ে তুলছি! ইদানিং মামাকেও পত্রিকায় বেশী বেশী রিপোর্ট লিখতে হয়। সম্পাদক সাহেব নাকি মামাকে বলে দিয়েছেন, আপনি এখন নামিদামি ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছেন, টেলিভিশনের টকশোতে আপনার উপস্তিতি প্রায় দেখা যায়, এখন প্রতি সাপ্তাহে একটা করে লিড ইনভেস্টিগেশন নিউজ লিখতে হবে। এতে প্রত্রিকার কাটতি বাড়বে। সেই করে মামার এখন এসাইনমেন্ট, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার। বিষয়টা মামার পড়াশুনার সাথে মিলে যায়, মামাও এই বিষয়ে ভাল মতামত দিতে পারেন। তবে টকশোতে শুধু এই বিষয়ে মতামত দিলে চলে না, সরকারের সমালোচনা না করলে ভাল টকশোবিদ হতে পারা যায় না। সরকারের পক্ষে কথা বলে অনেক টকশোবিদ এখন দালালে পরিনত হয়েছেন!

সম্পাদক সাহেব নাকি আরো বলেছেন, সিনেমার নায়ক নায়িকাদের চেয়ে টকশোর আলোচকরা কম নয়! সিনেমার নায়ক নায়িকারা মানুষকে শুধু বিনোদন দেয়! কিন্তু টকশোর আলোচকরা বিনোদনের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনেও ভুমিকা রাখে, সমাজের গন মতামতকে এক সুতায় গেঁথে তুলতে পারেন। মামা স্বাভাবিক ভাবে সম্পাদক সাহেবের কথায় প্যাঁচ ধরতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন! আরো ব্যাটা, সিনেমায় নায়ক নায়িকা আছে ভাল কথা, টকশোতে নায়িকা পেলি কোথায়? এত বড় একটা জনসংখ্যায় ভরা দেশে এখনো একজনও মহিলা টকশো আলোচক নেই! মামার বলেতে ইচ্ছা হয়েছিল, রাত বারটার পর টিভি দেখিস!

আসলে সব কথা সব জায়গায় বলা চলে না। চাকুরী করতে গেলে নিজকে আরো বেশী নতজানু মানুষ করে তুলতে হয় এবং সেই চাকুরীজীবী যদি বিবাহিত হয়, তা হলে তো কথাই নেই। আমার মামার হয়েছে সে দশা। টকশোতে আর কয় পয়সা পাওয়া যায়! মামী সহ ছেলে পুলেরা একটু টিভিতে দেখে মজা পায় মাত্র! যে সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয় না, তারা টিভিতে দেখে ফোন করে। ব্যস এইতো। চাকুরীর টাকাই সংসার চালাতে হয়। লিখতে না পারলে, পেটে ভাত জুটবে না এটাই চরম বাস্তবতা।

আধ ঘন্টা আগে মামাকে ফোন করেছিলাম। আমি যথারীতি আমাদের গলির মুখে। মামা বলেন - রিক্সায় আছি, আসছি। দাঁড়া, তোকে অনেক দিন দেখি না। মামার সাথে দেখা করার লোভ সামলাতে পারছি না। আমার বাসায়ও কিছু তাড়া আছে - থাক। কিছু দিন পর পরই মামার সাথে একটা সিগারেট চা আড্ডা না হলে মনটা ভাল যায় না। আর মামার সাথে দেখা হলে, নিজে যেমন নিজের মনের কথা বলতে পারি, পাশাপাশি মামাও না ধরনের কথা বলেন। দেশ নিয়ে মামার সাথে তেমন আলোচনা করি না। পরিবারের আলোচনা সহ মহল্লার নানা বিধ কথামালা থাকে বেশী। মামার কথায় নানা যুক্তি থাকে।

রিক্সা এসে দাঁড়ায়। মোটা মানিব্যাগ বের করে মামা ভাড়া পরিশোধ করে আমার সাথে হাত মিলান।
- কি খবর? কেমন আছিস?
; এই তো চলছে। আছি বেঁচে।
- শুনলাম তুই চাকুরী বদলে ফেলবি।
; কি আর করবো? এত কম টাকায় আর পারছি না। সপ্তাহে ছয় দিন, দিনে দশ ঘন্টা করে আর সইতে পারছি না। ভাবছি নূতন কেন জায়গা খুঁজে নিব।
- চাকুরী বেশী বদলানো ভাল নয়। এতে পরবর্তিতে সমস্যায় পড়ে যাবি।
; না বদলে উপায় কি বলো। না খেয়ে থাকব কি করে? বাজারের জিনিষ দামের ব্যাপারটা দেখছো। গত দেড় বছরে আমার এক টাকাও বেতন বাড়ে নাই অথচ বাজারের অবস্থা দেখ। বছর খানেক আগেও মাসে বাজার খরচ ছিল পাঁচ-সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মত। এখন দশ হাজারেও কুলাচ্ছে না।

সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আমরা করিম চাচার চা দোকানের দিকে যেতে থাকি।
- তোর মত অবস্থা ঢাকা শহরের অনেকেরই। সবাই একটা ক্রাহী মদুসুদন অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার মত বেতন পেয়ে আমাকেও তোর মোটা মামীসহ ছেলে মেয়ে নিয়ে একটা কষ্টকর জীবন পার করতে হচ্ছে। সাংবাদিকতার জন্য অনেকের কাছে যেতে হয়। সব দেখছি।
; টিভিতে টক শোতে তো বেশ ভাল ভাল কথা বল। শেয়ার মার্কেটে মার খাওয়া মানুষের পক্ষেও শক্ত করে কিছু বল না।
- দেশের উঠতি আলোচক হিসাবে এত হার্ড লাইনে সরকার বিরোধী কথা বলা যায় না। ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে, পরে আর কেহ ডাকবে না।

মামা কথা মিথ্যা বলেন নাই। যেই দেশ সেই বেশ। আমাদের দেশে সত্যের ভাত নেই। ক্ষমতায় গেলে সব সত্য মিথ্যা মনে হয়। মাটিতে পা পড়ে না। তবু আমি সাফাই গাই -
; আরো দূর। তুমি আছ ভুল পথে। সত্য কথার জুড়ি নাই, সত্য বলে মরে যাওয়াও ভাল।
- তোর বয়স হলেও এখনো কাঁচা রয়ে গেছিস। তোর মামীর মত এখনো তুই স্থুল বুদ্দি নিয়ে আছিস!
; কেন মামী আবার কি করল?
- প্রেম করে বিবাহের তের বছর পার হয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাতে তোর মামী বলে - আমাকে ঢাকা শহরের বাড়ীওয়ালার ছেলে ভেবে সে জীবনে প্রথম ভুল করেছিল।

চা'র কাপে চুমুক দিয়ে মামা আমার দিকে তাকান। মামা বলেন - জীবন ঢাকা শহরে এখন খুবই কঠিন। উপর থেকে যা দেখা যায় তা বেশীর ভাগ সময়ে মিথ্যা হয়। সাংবাদিকতা, টকশো নিয়ে আছি বটে। আর্থিক জটিলতা থেকে এখনো মুক্তি পাই নাই আর সে জন্য অনেক সংকীনর্তা থেকে এখনো মুক্তি মিলে নাই। ঢাকা শহরের বেশীর মানুষের এখন এমন এক মরন দশা চলছে।

প্রথম প্রকাশঃ চতুর্মাত্রিক(তারিখঃ ২৯ মে ২০১১, ৯:৪৮ অপরাহ্ন)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন